রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৩ অপরাহ্ন
ঝালকাঠি প্রতিনিধি॥ ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রভাতি শাখার ইনচার্জ সহকারী প্রধান শিক্ষিকা হোসনেয়ারা আরজু। যোগদানের পর আড়াই বছরেও ক্লাস নেননি, শিক্ষার্থীরাও তাকে চেনে না, নামও জানে না। অনেক শিক্ষকও তাকে বিদ্যালয়ে কখনো দেখেনি। এই শিক্ষিকাকেই বদলি করা হয়েছে ঝালকাঠি হরচন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য, তাকেই নিতে হবে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব। ২৯ মার্চ তাকে বদলি করা হলেও ১৪ দিন অতিবাহিত হলেও তিনি যোগদান করেননি। যে শিক্ষিকা তাঁর আগের কর্মস্থলে ঠিকমত উপস্থিত ছিলেন না, তাকেই আবার দেওয়া হচ্ছে আরেকটি বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব। এতে শঙ্কিত ঝালকাঠি সরকারি হরচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষর্থীরা। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরাও।
জানা যায়, ঝালকাঠি সরকারি হরচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিশ্বনাথ সাহা ২০১৯ সালে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেলে পদটি শূন্য হয়। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেন সহকারী শিক্ষক ফরিদ হোসেন। বছরের শুরুতেই সিরাজ সিকদার নামে একজন সহকারী শিক্ষক যোগদান করেন এ বিদ্যালয়ে। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তিনি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পাওয়া কথা থাকলেও তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ফরিদ হোসেনের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালকের কার্যালয়ের দ্বারস্ত হলেও কোন সুফল পাননি সিরাজ সিকদার। জোর করে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন ফরিদ হোসেন। এ অবস্থায় শিক্ষকরা পরেন বিপাকে। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় শিক্ষকরা। কেউ সিরাজ সিকদারের পক্ষে কেউ আবার ফরিদ হোসেনের পক্ষ নেন। একে অপরের সমালোচনায় জড়িয়ে পড়েন। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষকদের বিভাজনের প্রভাব পরেনি শিক্ষার্থীদের মাঝে। তবে শহরের অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা এ ঘটনায় ক্ষুব্দ। পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডিজি’র নির্দেশে ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ (বালক) বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা হোসনেয়ারা আরজুকে গত ২৯ মার্চ ঝালকাঠি হরচন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। নিয়মানুযায়ী নির্দেশের পরপরই তিনি কর্মস্থলে যোগদান করবেন। কিন্তু বদলির ১৪ দিন অতিবাহিত হলেও তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগ দেননি বলে শিক্ষকরা জানান।
আজ সোমবার সকালে ঝালকাঠি সরকারি হরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে তাঁর যোগদানের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ সময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক জানান, প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে দুই সহকারী শিক্ষকের লড়াই থামাতে নতুন একজন সহকারী প্রধান শিক্ষক দেওয়া হলেও তিনি অজ্ঞাত কারণে যোগদান করছেন না। শোনা যাচ্ছে তিনি যোগদান করলেও আবার ছুটি নিয়ে দীর্ঘদিনের জন্য চলে যেতে পারেন। তাহলে বিদ্যালয়ের যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তা রয়েই যাবে। এ বিদ্যালয়ে বর্তমানে জ্যেষ্ঠতার কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। জোর যার, তিনিই প্রধান শিক্ষকের পদ দখল করেন। এদিকে যাকে বদলি করে আনা হচ্ছে, তিনি আগের কর্মস্থলে আড়াই বছরে ঠিকমতো আসেননি। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হলে বিদ্যালয়ের জটিলতার কোনো অবসান হবে না। তাই বিদ্যালয়ের শূন্যপদে একজন প্রধান শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ (বালক) বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে হোসনেয়ারা আরজু ২০১৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর যোগদান করেন। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তাকে প্রভাতি শাখার ইনচার্জ করা হয়। যোগদানের পর কয়েকদিন তিনি বিদ্যালয়ে আসেন। পরবর্তীতে নানা সময় ছুটি নিয়ে তিনি আড়াই বছরে ঠিকমতো বিদ্যালয়ে আসেননি। তাঁর বাসা বরিশালে হওয়ায় মাঝে মধ্যে তিনি একটি মাইক্রোবাসে করে ঝালকাঠি কর্মস্থলে এসে হাজিরা খাতায় সই দিয়ে চলে যেতেন। এ সুযোগে বিদ্যালয়ের প্রভাতি ও দিবা শাখার দায়িত্ব পালন করেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা মারুফা বেগম। অভিযোগ রয়েছে দুই শাখার দায়িত্ব পালনের জন্যই তিনি হোসনেয়ারা আরজুকে একাধিকবার ছুটিসহ নানা সুবিধার সুযোগ করে দিতেন।
বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রেজোয়ান ইসলাম বলে, ‘হোসনেয়ারা আরজু নামে কোনো শিক্ষিকাকে আমি চিনি না। তিনি কখনো আমাদের ক্লাস নেননি।’ নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন বলে, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক-ক্ষিকাকে আমি চিনি। কিন্তু হোসনেয়ারা আরজু নামে কোনো ম্যাডামকে কখনো দেখিনি। এ নামে কোনো শিক্ষক আমাদের ক্লাস নেননি।’
ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ (বালক) বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মারুফা বেগম বলেন, হোসনেয়ারা আরজু শারীরিকভাবে একটু অসুস্থ। এখন করোনার মধ্যে আসেননি। আগে ছুটিতে থাকা ছাড়া তিনি বিদ্যালয়ে আসতেন। আড়াই বছরে তিনি কতদিন ছুটিতে ছিলেন এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেননি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তিনি আরো বলেন, হোসনেয়ারা আরজু এখন আমাদের বিদ্যালয়ে নেই, তাকে ঝালকাঠি হরচন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়েছে।
ঝালকাঠি হরচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, হোসনেয়ারা আরজু এখনো বিদ্যালয়ে যোগদান করেননি। তিনি যোগদান করলেও মন্ত্রণালয় থেকে তাকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিতে হবে। এতে সময় লেগে যেতে পারে। ততক্ষণ পর্যন্ত আগের যিনি দায়িত্বে আছেন ফরিদ হোসেন, তিনিই থাকবেন। তাহলে বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়ে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়ে, তা রয়েই যাবে। হোসনেয়ারা আরজু তাঁর পূর্বের কর্মস্থলেই ঠিকমতো আসেননি, তাকে নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাক সবাই চিন্তিত।
শিক্ষকদের অভিযোগ, তিনি এ বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েও ঠিকমতো আসবেন না। এতে বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম ও শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হতে পারে। তাই শূন্য পদে নতুন একজন প্রধান শিক্ষকের নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
নতুন বদলি হওয়া শিক্ষিকা হোসনেয়ারা আরজুর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তাঁর ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি তা ধরেননি। পরে তাকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও, তার জবাব দেননি তিনি।
ঝালকাঠি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হলেও সরকারি বিদ্যালয়ের কোনো তথ্য আমাদের জানায় না। তবে শুনেছি সরকারি হরচন্দ্র বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় দায়িত্ব পালন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এখানে নতুন একজন সহকারী প্রধান শিক্ষকে বদলি করা হয়েছে। তিনি যোগদান করলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পাবেন।
Leave a Reply